সময়টা ১৯৮০ সালের দিকে…
তখনও আধুনিকতা স্পর্শ করে নি। না ছিল ওয়াটসঅ্যাপ,না ছিল ফেসবুক, না ছিল কোন প্রকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। যোগাযোগের ক্ষেত্রে চিঠি-ই ছিল জনপ্রিয়। খুব কম সংখ্যকদের কাছেই ছিল ল্যান্ডফোন!
— সেই ব্যাকডেটেড যুগের বেড়ে ওঠা এক তরুন ছিলাম আমি রিশাদ। সেসময় এক পত্রিকায় কিশোর সংকলন এ ক্ষুদে গল্প লিখতাম! লেখা প্রায় ছাপা হত। তাই নিয়মিতই পাঠাতাম….
— একদিন এক চিঠি পেলাম। দেখলাম চিঠি নওগাঁ থেকে এসেছে। অবাক হলাম,নওগাঁ থেকে তো চিঠি আসার কথা না,কারণ কেউ ছিল না আমার পরিচিত সেখানে…
খানিকটা উৎসাহ নিয়ে চিঠিটা খুললাম…..
শ্রদ্ধেয় লেখক,আশা করি ভাল আছেন। আমি মুনতাহা। আপনার গল্প আমার বেশ ভালো লাগে।ঠিকানা কই পেলাম অবাক হচ্ছেন নিশ্চই। একটা কাজে ঢাকা গিয়েছিলাম,সেখানে পত্রিকা অফিস থেকে অনেক কষ্টে কালেক্ট করেছি। তাই চিঠি লিখা আরকি। আশা করি আমার বন্ধু হবেন।
আপনার ছোট খাটো ফ্যান
“মুনতাহা”
চিঠি টা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম। কারণ কেউ কখনো এভাবে চিঠি লিখেনি,তাও আবার একটা মেয়ে!
চিঠিটার ইতিবাচক উত্তর দিলাম। বন্ধুত্ব হল। কথা হত চিঠিতেই। সব অভিমান, রাগ, দুষ্টুমির বাহক ছিল চিঠি। মুনতাহা পড়ত ক্লাস ১০ এ আর আমি ছিলাম ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী।
চট্রগ্রাম থেকে নওগাঁর দূরত্ব অনেক হলেও আমাদের বন্ধুত্ব-এর মাঝে দূরত্ব ছিল না। খুব কাছাকাছি ছিলাম দূরে থেকেও।
চিঠি আসত ৩ দিন পর অথবা ৭ দিন পর। কখনো কখনো ১৫ দিনের ও বেশি লেগে যেত। দিনগুলোতে অপেক্ষার প্রহর গুনতাম। মিস করতাম খুব। চিঠি যখন আসতে দেরি করত তখন খুব কষ্ট হত। দরজায় কারো সাড়া পেলেই ছুটে দেখতাম চিঠি এসেছে কিনা।
মুনতাহা ও বোধ হয় নিজের অগোছালো চুলগুলোকে পরোয়া না করে ছুটে যেত দরজায় দেখার জন্য যে ডাকপিয়ন চিঠি এনেছে কি! হয়ত সেও ব্যাকুল ছিল আমার পত্রের অভিপ্রায়ে!
আমরা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলি। শুধু চিঠি আদান প্রদান করেই। তবে নিজের মনের মধ্যে অবয়ব সৃষ্টি করে চিন্তা করতাম, সে কেমন হবে দেখতে। হবে আমার রূপপরী, হবে সে অপরূপা!
–একদিন চিঠিতে তার একটি ছবি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি। সে নিজের একটা সাদা-কালো ছবি দেয়। সে ছবি দেখে আমি আবারো প্রেমে পড়েছিলাম। যখন চিঠি আসত না,তখন সেই ছবি দেখেই মুনতাহার অনুপস্থিতি ঘুচতাম। মনে হত সে এই ছবির মধ্যদিয়ে কথা বলছে। এমন লাগত যেন ছবিটি বলছে-” রিশাধ চিন্তা কেন কর? আমি তো আছিই তোমার পাশে।”
ভাবতাম উত্তরে পাঠানো আমার ছবিটা দেখেও সে একইভাবে অনুপস্থিতিকে ক্ষলন করে। কেউ আসলে হয়ত বালিশের নিচে তা লুকিয়ে ফেলে। যখন চিঠি আসে না,তখন হয়ত মুনতাহা আমার ছবির দিকে তাকিয়েই চোখের কোনে শিশির বিন্দু জমা করে আর প্রতিক্ষার প্রহর গুনে…
— একবার আমার টাইফয়েড হয়েছিল। তাকে চিঠিতে অতি ব্যঙসূরে লিখেছিলাম..”আমি অনেক অসুস্থ, আমার বাচার সম্ভাবনা নেই,দোয়া কোরো।
উত্তরে যা পেলাম তা কখনো কল্পনা করি নি…
মুনতাহা- দয়া করে এমন মজা কোরো না। আমি নিজেই মৃত্যু পথযাত্রী। আমার নিজেকে অপয়া মনে হচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল আমি বাচবা না বলে আমার প্রিয় মানুষও বাচবে না কেন?
তুমি অনেক অভিঘানিত হয়েছ জানি। কিন্ত সত্যিটা তোমার জানতেই হত একদিন। আমি টিবি-আই এর থার্ড স্টেজে আছি। ডাক্তার আমার বেচে থাকাকে মিরাকেল মনে করেন। তারা ৩ বছর সময় দিয়েছিলেন এখন ২.৫ বছর শেষ। এর মধ্যে কোনো একটা সময়ে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। মনে হয় আমাদের আর দেখা হবে না। আর হ্যা তুমি আমার জন্য চিন্তা করবে না একদম। যখন আমার সময় হয়ে আসবে, তখন একটা অবয়ব হয়ে আসব তোমার কাছে। তোমার হাতটা ধরে বলব “চলে যাচ্ছি আজ রিশাধ,ওপারে দেখা হবে”
চিঠিটা পড়ে আমার শরীর কেমন ঠান্ডা হয়ে আসল। আমি মেঝেতে বসে পড়লাম। মাথায় সবকিছু কেমনটা জট বেধে আসছিল। দেরি না করে চিঠি লিখা শুরু করলাম…..
— আরে পাগলী মৃত্যু পথযাত্রী কেন বলো নিজেকে? একটা শিশু যখন জন্ম নেয়,তখন থেকেই সে মৃত্যু পথযাত্রী হয়ে যায়। আমরাও বেচে আছি মিরাকেলের জোরে। কাল কে বেচে থাকবে সেটার নিশ্চয়তা কারো কাছে নেই। আর কেন বললে দেখা হবে না? অবশ্যই হবে। আমি আসব নওগাঁ ২ মাস পর, শুধু একটাবার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাক। একটু কষ্ট করে অপেক্ষা করো..
ইতি তোমার
“রিশাধ”
উত্তরে সে চিঠিতে ঠিকানা পাঠায়। আর লিখা দেখে বুঝা যাচ্ছিল অনেক খুশি হয়েছে সে। পরীক্ষা শেষ হলো। আমি যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। ১৮-২০ ঘন্টার পথ পেরিয়ে পৌছালাম নওগাঁয়। ঠিকানা মত গেলাম। চিঠিতে মুনতাহা বলেছিল সামনে দিয়ে না এসে পিছন দিয়ে আসতে।
তাই যেমন কথা তেমন কাজ। বাড়ির পিছনের দেয়াল বেয়ে উঠে ঝোপে গিয়ে লুকালাম।
বারান্দা খোলা। নিশ্চই মুনতাহা ভিতরে আছে। ডাক দিব কিভাবে ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাত আসা বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে বারান্দায় নুড়ি মারা শুরু করলাম।
নীল কামিজ আর খোলা চুলে এক রমনী বেরিয়ে এসে এদিক ওদিক বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাতে থাকে। আর ঝোপে লুকিয়ে থাকা রিশাধটা আবারো প্রেমে পড়ে যায়।
আমাকে ঝোপে লুকিয়ে থাকা দেখে এক গাল হেসে নিল সে। ইশারা করে আর পিছনদিকের বাগানটায় নেমে আসে। আমরা মুখোমুখি হই। দু জনেই ছিলাম বাকরুদ্ধ। নানা রকম জড়তার কারনে পারছিলাম না দুজন-দুজনকে জড়িয়ে ধরতে..
নিরবতা টা আমি ভাঙলাম…
-ভা..ভা..ভালো আছ?
– (ইতিবাচক উত্তর দিয়ে মাথা ঝাকাল)
– তো বাড়িতে কি কেউ নেই?
– না আছে,সবাই ঘুমুচ্ছে
– তো তুমি ঘুমোও নি?
– না কিভাবে ঘুমাব? তুমি আসবে বলেছিলে না? (লাজুকলতার মত করে)
– উত্তর দিতে না পেরে আমি শুধু হেসেছিলাম…
– তুমি অপেক্ষা কর,আমি তৈরি হয়ে আসছি…
-(মাথা ঝাকালাম)
— সে ভিতরে চলে গেল। ভাবলাম এতটা কিভাবে ভালোবাসতে পারে কেউ? যাহোক মাথাটা অনেক ধরেছে। অনেকটুকু পথ ভ্রমন করেছি।সকাল ৬ টা বাজে,ক্ষিধেও লেগেছে প্রচুর…
– কি মশাই ক্ষিধে লেগেছে খুব?
– (মুনতাহার কথায় ঘোর কাটল) হ্যা মানে না,না লাগে নি।
– হুহ! মিথ্যে কেন বল? তোমার জন্য নিজ হাতে নাস্তা বানিয়ে রেখেছিলাম। কখন আসবে না আসবে,ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। গরম করে এনেছি। খেয়ে নাও…
– আমি শুধু তার দিকে আমি শুধু তার দিকে তাকিয়েছিলাম
– কি ব্যাপার? খাও না..
– হ্যা হ্যা, খাচ্ছি।
( আমার রাক্ষুসে ভক্ষন দেখে সে হাসতে হাসতে বলে) আমরা এখন কুঠিবাড়ি যাব,এরপর একটা পার্কে, সেখান থেকে একটু দূরে একটা গ্রাম আছে। সেখানকার একটা খাল খুব সুন্দর। ডিঙি নোউকায় আমরা খালটাতে চড়ে বেড়াব, দুপুরের খাবার টা নোউকাতেই খাব! খাবার সাথে নিয়ে এসেছি! মজা হবে তাই না?
তুমি এত কিছু প্ল্যান করে ফেললা!! ( গিলতে গিলতে)
– জী। শেষ বারের মত দেখা হচ্ছে, তাও আমি আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখন যেহেতু তুমি সামনে। এটাই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন হতে যাচ্ছে আমার জন্য।
– এমন করে কেন বল? ধ্যাত!
– হয়েছে মুখ কালো করতে হবে না! তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও বের হতে হবে।
– হুম,খাচ্ছি তো!
— পুরো দিন একসাথে কাটালাম। আমারো সবচাইতে সুন্দরতম দিন ছিল সেটি। ফিরে আসতে একদমই ইচ্ছা করছিল না আমার।
– বাস ছেড়ে দিবে কিছুক্ষন পর, আমার না চট্রগ্রাম ফিরে যেতে একেবারেই ইচ্ছা করছে না। (আমি)
– গাধা! যেতে তো হবেই। আর মনে হয় না দেখা হবে। মৃত্যুর খবর টা পেলে একবার কবরটা যিয়ারত করতে এস কিন্তু…
– (আমি কেঁদে তাকে জড়িয়ে ধরলাম) একদম বাজে কথা বলবে না। তোমার সাথে আবারো দেখা হবে। পরের বার এসে তোমাকে চট্রগ্রাম নিয়ে যাব!
– উহু! মেয়েদের মত কান্না কেন করছ?
– করব কান্না! সমস্যা আছে কোনো তোমার? বাচবে তুমি দেখে নিও! প্রত্যেক দিন নামাজ পড়ে আমি দোয়া করব তোমার জন্য,আমার কথা আল্লাহতালা ঠিকই শুনবে দেখে নিও।
– হা বাবা,বাচব আমি। যতদিন তুমি পাশে আছ আমার ততদিন কিছু হবে না। বাস ছেড়ে দিচ্ছে। যাও!…আরে যাও না!
যাওয়ার সময় মুনতাহা একটুও কান্না করে নি। কারন সে জানত, নিজেই আবেগপ্রবণ হলে আমাকে সামলাতে পারবে না।
— চট্রগ্রাম এসে দু-তিন বার চিঠি আদান-প্রদান হয়। কিন্তু হঠাত করে চিঠি আর আসলো না। ১০ টি চিঠি পাঠিয়েছিলাম। ৪ মাসে একটির ও উত্তর আসে নি। নানা রকম বাজে চিন্তা মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। পরক্ষনে ভাবলাম, না মুনতাহা পারবে মিরাকেল কে রিয়েলিটিতে নিতে। কিছু হবে না ওর।
একটা ভার্সিটিতে এডমিশন নিয়ে ৪ মাস পর
আবারো পাড়ি জমালাম ৫১০ কি:মি: দূরের সেই নওগাঁয়।
পিছন দিয়ে আবারো দেয়াল বেয়ে উঠলাম। বারান্দা বন্ধ ছিল। অনেক নুড়ি পাথর ছুড়লাম। কেউই বেরিয়ে এল না। নিরূপায় হয়ে হয়ে বাড়ির সামনের দিকে এগুতে দেখলাম…
পিছন দিক থেকে একটা মেয়ে গেটের লেটার বক্সের তালা খুলে একগাদা চিঠি বের করছে আর বেছে বেছে দেখছে…
-এক্সকিউজমি, এটা মুনতাহার বাসা না? তারা কি বাড়িতে নেই? কিছু জানেন? (আমি)
– মেয়েটা হঠাত থমকে দাঁড়াল, কোনো উত্তর দিচ্ছিল না।
– কি ব্যাপার, কথা বলছেন না কেন?
— মেয়েটি ঘুরে তাকায়, সেই দৃশ্য টা ছিল আমার জীবনের সেরা দৃশ্য। মেয়েটা আর কেউই না, মেয়েটি ছিল আমার মুনতাহা। ঘুরে তাকাতেই তার হাতের থাকা চিঠি গুলো নিচে পড়ে যায়। মুনতাহা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে…
– কই ছিলে তুমি মুনতাহা? ৪ টা মাস তোমার একটা চিঠির জন্য অপেক্ষা করেছি।
– আমাকে ক্ষমা কোরো রিশাধ। আমি ভারতে গিয়েছিলাম চিকিৎসার জন্য.. রিশাধ আমি পেরেছি। পেরেছি মিরাকেলকে বাস্তবে রূপ দিতে।
– আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার দিকে তাকালাম। সে কাঁদছে..আমিও অশ্রু ধরে রাখতে পারি নি। কাঁদতে কাঁদতে আবারো তাকে জড়িয়ে ধরলাম!
— অন্য সব গল্পের মত আমাদের গল্পটাও হতে পারত। আমি নওগাঁ এসে কারো কাছ থেকে সুনতে পারতাম মুনতাহা আর নেই,কেউ আমাকে কবর পর্যন্ত নিয়ে যেত। কিন্তু না আমাদের গল্প টা ব্যাতিক্রম…আমার মুনতাহা পেরেছে,আল্লাহপাক শুনেছিলেন আমার কথা।
মুনতাহা পেরেছে দৃড়তা দিয়ে অলৌকিককে বাস্তবে রূপান্তর করতে, সে পেরেছে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে নিজেকে বের করে নিতে, সে পেরেছে বেচে থাকার সপ্ন কে সত্যি করতে। হ্যা আমার মুনতাহা পেরেছে।
Leave a Reply